প্রকাশিত: Sat, Apr 20, 2024 1:41 PM
আপডেট: Sun, May 19, 2024 8:29 AM

খুঁজে নেওয়ার স্বাধীনতাটা জরুরি

সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু : আমি এবং আমার বয়সী যাঁরা তারা ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’য় যেমন অংশ নিয়েছি, ঠিক তেমনি ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ও মিস করিনি। এই দেশে আনন্দ শোভাযাত্রা  অথবা মঙ্গলশোভাযাত্রার ইতিহাস খুববেশি পুরোন নয়। যারা বয়সগত কারণে আনন্দশোভাযাত্রায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাননি তাঁদের চেয়ে আমরা অনেক ভাগ্যবান। কিন্তু মজার একটি বিষয় লক্ষ্য করছি,  যারা এই সময় পহেলা বৈশাখ নিয়ে পত্রিকায়, অনলাইনে লিখছেন, টকশোতে বলছেন তারা আনন্দশোভাযাত্রার অধ্যায়টুকুকে ভুলে বসে আছেন, অথবা সচেতনভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন। অথচ তারা বয়সের দিক থেকে প্রায় আমাদেরই সমবয়েসী। আনন্দশোভাযাত্রাই হোক আর মঙ্গলশোভাযাত্রাই হোক বাঙালির রক্তপ্রবাহে উৎসবের স্রোত হাজার বছর ধরে বহমান। উৎসবের রূপ, উপলক্ষ বদলাতে পারে, উৎসবের নেশা আমাদের বদলাবে না, এই নেশা অন্তর্গত, রক্তপ্রবাহে বহমান। এটিকে থামানোর শক্তি কারও নেই। তাই পহেলা বৈশাখে উৎসবের ভবিষ্যৎ নিয়ে যারা অতি চিন্তিত তাদের অতিচিন্তার কারণ নেই। 

যারা এর বিরুদ্ধে বলেন তারা বলবেনই, যারা পহেলা বৈশাখ পালন করবেন তারা পালন করবেনই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বিতর্ক। এই বিতর্ক উসকে দেওয়ার কাজটি দুই পক্ষের অসুস্থ মানুষেরা করেই যাচ্ছেন। তাই বলে উৎসব থেমে থাকবে না, পহেলা বৈশাখের উৎসব চলবেই। এই ধারার উৎসবপ্রিয় মানুষেরা সব বিতর্ক, সব বাধা, সবকিছু মেনে নিয়ে, উপেক্ষা করে নববর্ষের উৎসবে যাবেই, বাকি অংশ মঙ্গলশোভাযাত্রা থেকে দূরে, আরও দূরে সরে যেতে থাকবে। একপক্ষ মঙ্গলশোভাযাত্রাকে টোটালি বন্ধ করতে চাইছে, আরেকপক্ষ মঙ্গলশোভাযাত্রাকে নিয়ে যেতে চাইছে হাজার বছরের পুরোন চিত্রে-চরিত্রে। দুইপক্ষ যতদিন অনড় থাকবে ততদিন এ বিতর্ক বাড়বেই।  এ বিতর্ক অবসানের পথ একটাই, সেটা হলো বিতর্ক না তুলে মানুষের ইচ্ছা, মানুষের আকাক্সক্ষাকে সম্মান জানিয়ে চুপ থাকা, মানুষকে তার পচ্ছন্দ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া এবং সেটাকে মেনে নেওয়া। পাকিস্তান আমলের কথাই ধরি, সেটি ছিল আমাদের ছোটবেলা। ইসলামিক বা ঘোষিত মুসলিম রাষ্ট্র ছিল পাকিস্তান। অথচ সে আমলে মেলা, পার্বনের তো কমতি দেখিনি, বাধাও দেখিনি কোথাও। না মোল্লারা বাধা দিয়েছে, না দিয়েছে  পাকিস্তান সরকার। আমাদের এই মানিকগঞ্জেই কম করে হলেও অর্ধশত মেলা বসতো বিভিন্ন উপলক্ষে, বিভন্ন জায়গায়। শহরের প্রধান সড়কজুড়ে বসতো রথের মেলা। একদিন না টানা ৭দিন ধরে। রথযাত্রা স্পষ্টতই সনাতন হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষের ধর্মীয় অনুষ্ঠান। কই সে রথের মেলায় যাবার আগে, পরে আমি বা আমরা তো ভাবিনি হিন্দুদের মেলায় যাচ্ছি। মুসলমানেরা গেছে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের চেয়ে দ্বিগুন সংখ্যায়। ভীরের চাপ থেকে বাঁচতে আমি নিজে বাবার কাঁধে চড়ে কালীবাড়ির ভিতরে মেলার মূল অংশে গেছি। বাবার হাত ধরে গেছি, বড় হয়ে একা একা গেছি। নিজে বাবা হবার পর আমি আমার মেয়েকে নিয়ে গেছি। এখন সেই রথের মেলা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আকারে টিকে আছে, তবুও ষাট পেরুনো বয়সেও একবার হলেও যাই। 

আমার স্পষ্ট মনে আছে আমাদের গ্রামের বাড়ির পাশের গ্রাম রামদিয়া নালীর রাধাচক্করের মেলা, গড়পাড়ার বুড়ির মেলা, বেতিলার রাস মেলা আরও অনেক মেলায় স্মৃতি। রাধাচক্করের মেলায় যেতাম কাঁচা আম কাটার বাহারী ছুরি, চাকু কেনার জন্য, বুড়ির মেলায় ঘুড্ডির জন্য। বেতিলা রাশমেলায় যেতাম মাটির চাকার টমটম গাড়ির জন্য, যেবার না যেতাম, সেবার বাবা নিয়ে আসতেন টমটম গাড়ি। টমটমের মাথায় বাঁধা রশি ধরে বাড়ির উঠানে, পাড়ার এবাড়ি ওবাড়ির উঠান আঙিনা টমটমের টাশ টাশ শব্দে অস্থির করে রাখতাম। আমাদের দেখা প্রাণপূর্ণ সেসব মেলা কেন তিনযুগ, চার যুগেই মরে গেলো, হারিয়ে গেলো, সে খবর কি কেউ করেছি, করিনি। দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি এসব মেলা কট্টর মোল্লাদের জন্য হারায়নি, বন্ধও হয়নি। হারিয়েছে আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতির উদাসীনতা, মেলার গুরুত্ব বুঝতে না পারা এবং সংস্কৃতির অঙ্গনে কর্পোরেট আধিপত্যের কারণে। রাজনীতির দুর্বৃত্বায়ন, চমক, চাকচিক্য আর সবকিছুকে শহুরীকরণের মানসিকতার ফলেও এই বিপর্যয়। 

আমাদের মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক জগতের নিয়ন্ত্রণ আর প্রভুত্ব যেদিন একপাল ভÐ, চতুর ব্যবসায়ী, লোভী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের হাতে চলে গেছে সেদিনই আবহমান বাংলার মেলা, উৎসব-পার্বনের মৃত্যু ঘটেছে। পহেলা বৈশাখে বাবার সাথে নতুন পোশাক পরে মেট্রো টেইলার্সে, বিশ্বাস ক্লথ স্টোরে হালখাতার দাওয়াতে গিয়ে মিষ্টি, ফলাহার করেছি। কই তখনতো এমন  বিতর্কেরর ঝড় দেখিনি। বাড়িতে কোনোদিন কাঁসুন্দি বানানো হয়নি, মা বানাতে পারতেন না বলে। কিন্তু প্রতি বৈশাখে মাটির হাঁড়িতে ভরে কাঁসুন্দি আসতো বাবার হিন্দু বন্ধুদের বাড়ি থেকে। সারাবছর সে কাঁসুন্দি আমরা খেয়েছি। বাবা নেই তাই  কাসুন্দিও এখন আর আসে না। পরাধীন দেশে যেটা হয়নি স্বাধীন দেশে বৈশাখ পালন নিয়ে সেটা হচ্ছে, বিতর্ক দিন যাচ্ছে বাড়ছে। বিরোধ তীব্র হচ্ছে। একদিকে এই বিরোধ বাড়ছে কট্টর, অর্ধশিক্ষিত কিছু মোল্লা, কট্টর পন্থায় বিশ্বাসী, কিছু অতিধার্মিক মানুষের  কারণে।

অন্যদিকে বিরোধ বাড়ছে, তীব্র হচ্ছে পহেলা বৈশাখ আর মঙ্গলশোভাযাত্রা বিরোধী মানুষকে জবাব দিতে গিয়ে তাদের ধর্মকে টেনে আনা, আর  উদ্দেশ্যমূলকভাবে সে  ধর্মকে ঢালাওভাবে খোঁচানো কিছু মানুষের  কারণে। এরা ভুলে যায় ধর্মবিশ্বাসী, ধর্মপালনকারী মানুষমাত্রই রক্ষণশীল, উগ্রমানুষ না। সবচেয়ে বড় কথা রাজনীতিটা সবকিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, রাজনীতি নষ্টতো সব নষ্ট।  নষ্ট রাজনীতির শহরে, দেশে, বাস করে মেলা, উৎসবের বিতর্কহীন সুস্থতা আশা করা আহাম্মকী।রাজনীতি, রাজনীতিক যেখানে যত সুস্থ সেখানে বিরোধ, বিতর্ক, ধর্মান্ধতা, ধর্মবিরোধিতাও তত কম। ধর্মের দেয়াল দিয়ে সবকিছুকে বাঁধতে যাওয়া যেমন মূর্খতা, বর্বরতা, ঠিক তেমনি ঐতিহ্যচেতনা, সংস্কৃতিকে ক্যাপসুল বানিয়ে সবাইকে গেলানোর চেষ্টা করাও, মূর্খতা, বর্বরতা। মানুষের উপর বিশ্বাস রেখে দুটো বিষয়কে মুক্ত রাখাতেই মঙ্গল। কারণ দিন শেষে মানুষ ঠিকই তার নিজ নিজ ঠিকানা খুঁজে নেয়। এই খুঁজে নেওয়ার স্বাধীনতা না থাকাটা কারও জন্যই মঙ্গলকর নয়, আত্মঘাতী। ১৮.৪.২৪। ফেসবুক থেকে